লেখক – মনিপুষ্পক খাঁ।
বসন্ত উৎসব মানেই যে জায়গায় নাম কথায় কথায় ভেসে আসে তা শান্তিনিকেতন। দোলের দিন হাজার হাজার বাঙালির ঠিকানা শান্তিনিকেতন। হোলির দিনে যখন দিকে দিকে উদ্দামতা, ভোজপুরি গানে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে নৃত্য, শান্তিনিকেতনে তখন সুশৃঙ্খল আনন্দগান ও নাচের অনুষ্ঠান। সকাল থেকেই যেন উৎসবের চেহারা চারিধারে। বেজে ওঠে সেই চেনা গান – ” ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল “
রবীন্দ্রনাথ তাঁর”বসন্ত ও বর্ষা” নিবন্ধে লিখেছিলেন বসন্ত উদাসীন, গৃহত্যাগী। বসন্ত আমাদের মনকে চারিধারে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়, বসন্তে আমাদের মন অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়া যায়, বাতাসের উপর ভাসিতে থাকে, ফুলের গন্ধে মাতাল হইয়া জ্যোৎস্নার মধ্যে ঘুমাইয়া পড়ে। আসলে রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় বসন্তকালে মানুষের মন যে বহির্জগতের ছড়িয়ে পড়ে ,সেই ছড়িয়ে পড়া মনের জন্যই বসন্তোৎসব। কবি পাঁক,কাঁদা নিয়ে ল্যাঙট পরা অ -বাঙালিদের হোলি খেলা দেখেছিলেন। সে দৃশ্যে মনের কোনো বাঁধন ছিল না, শ্রীময়তাও ছিল না বিন্দুমাত্র। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন উন্মুক্তির জীবনযাত্রায় সৌন্দর্যের শ্রী থাকা উচিত। মন খুলে বাঁচার পক্ষপাতী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু মনের দ্বার খোলা রাখার বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সংযত ও সাবধানী। তাঁর মতে যেকোনো অসামঞ্জস্যই অসুন্দর। ঠিক যেমন ল্যাঙট পড়ে হোলি খেলার মধ্যে তা পরিলক্ষিত হয়। সেইদিক থেকে বিক্ষিপ্ত মন পথে নেমে যাতে মুক্তি পায়,আরাম পায় তার জন্যই বসন্তোৎসব।কবির শান্তিনিকেতনের বসন্ত বন্দনা এই মর্ম কথাই প্রকাশ করে। রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনা কেবল বসন্তের জন্য নয়, দেশ ও পৃথিবীর সাধারণ মানুষের জীবন বোধের জন্যও সত্য। অনেকে বসন্তোৎসবের সাথেই দোল ও হোলি কে সমর্থক মনে করেন। কিন্তু তার নিহিতার্থটি সম্পূর্ণ আলাদা।আর শান্তিনিকেতনের ক্ষেত্রে এর ধারণাটাই বদলে যায়। হোলির সাথে হোলিকা দহনের কাহিনী মিশে আছে। এখানে হোলিকা নামক অসুরের দহন করে অশুভ শক্তির বিনাশ ও হোলিকা নাশের গল্প থেকেই হোলি উৎসবের সূচনা হয়,যার মধ্যে দিয়ে অশুভ শক্তিকে বিনাশ করে রঙের উৎসবের সূচনা করা হয়। সেইদিক থেকে দোলের ধারনার বিষয় হলো বৈষ্ণবতা। কৃষ্ণ রাধা ও গোপীদের সাথে রং খেলতেন।সেই রং খেলার রীতি সমাজ সংস্কৃতিতে দোল উৎসব হয়ে ওঠে। সেইদিক থেকে রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় শান্তিনিকেতনের দোল ছিল আনন্দ উৎসব। শান্তিনিকেতনে কখনোই ধর্মীয় আচার আনুষঙ্গ কে অনুমোদন দেয়া হয়নি। অথচ উৎসবেরও আনন্দে ঘাটতি পড়েনি। আসলে রবীন্দ্রনাথ সুচিন্তিত ভাবে দোল আর হোলির সেই যুগল ঐতিহ্যকে বসন্তোৎসবের মধ্যে দিয়ে শ্রীময় ও সু সংস্কৃতির প্রতীক করে তুলেছিলেন, যা হয়ে উঠেছিল শুধুই বর্ণময় ঋতু উৎসব। শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবের সাথে ধর্মীয় যোগ না থাকার জন্যই প্রচলিত পাঁজির দিনের সঙ্গে বসন্তোৎসবের দিনক্ষণ অনেক সময়ই মিলতো না।

কেউ কেউ মনে করেন ১৯০৭ সালের ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে যে ঋতু উৎসবের সূচনা হয় তার পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত রূপ শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব। কিন্তু কথাটা ঠিক বললে বলতে হয় বালক শমীন্দ্রনাথ ১৩১৩ বঙ্গাব্দের শ্রী পঞ্চমী তিথিতে শান্তিনিকেতনে যদি সে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেও থাকেন তাহলেও তা ছিল একটি ঋতু উৎসব। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় সে প্রসঙ্গে লিখেছেন- ১৭ ই ফেব্রুয়ারির সেই উৎসবে শমীন্দ্রনাথ ও আরো দুইজন ছাত্র বসন্ত সাজে, একজন সাজে বর্ষা আর তিনজন সাজে শরৎ। প্রভাতকুমার অবশ্য সেই উৎসবের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না। তবে শমীন্দ্রনাথের একটি পত্রাংশ থেকে তিনি নাকি সেই দিনের উৎসবের বিবরণ পেয়েছিলেন। তবে পঞ্চমী তিথিতে পরবর্তী সময়েও শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব আয়োজিত হয়েছে। প্রকৃতি সেজে উঠলেই আশ্রমিকদের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠত বসন্ত। বসন্তকে বরণ করার জন্য ফাল্গুনী পূর্ণিমা পর্যন্ত অপেক্ষা তখনও তেমন আবশ্যক হয়ে ওঠেনি। যেমন ১৯২৩ সালের মাঘী পূর্ণিমায় শান্তিনিকেতনে বসন্তের গানের আসর বসেছিল। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় আশ্রম সম্মিলনীর অধিবেশনে আবারো বসন্তোৎসব হয়। আসলে শান্তিনিকেতনের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথের বিদেশ যাত্রা বা অন্যদিক মাথায় রেখে কোন এক নির্দিষ্ট দিনে আশ্রমবাসী মিলিত হতেন বসন্তের আনন্দ অনুষ্ঠানে। আসলে ধর্মের ছুঁতমার্গ, সামাজিক বিধি নিষেধ বা লোকাচারের বিপক্ষে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব আসলে আন্তরিক, অ মলিন আনন্দের উৎসব। যা শ্রী আর সহজের সংমিশ্রনে গঠিত।

রবীন্দ্র চিন্তায় শ্রী ছিল বলেই দুর্গাপূজা এড়িয়ে শারদোৎসব, বিশ্বকর্মা কে সম্মান দিয়েই শিল্পোৎসব। নববর্ষের দিন গণেশ বা এলাহি ভরসা, আমপাতা, সিঁদুর, পঞ্জিকা হালখাতা আর লাড্ডু ছাড়াও যেন নববর্ষ পালন হতে পারে তা শিখিয়েছেনও প্রয়োগ করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সেই ভাবনার বিবর্তন হল বসন্তোৎসব।
রবীন্দ্রনাথের সেই দেখিয়ে যাওয়া শ্রী আর সহজের ভাবনাকে এই যুগে এসে বহন করা আমাদের অন্যতম কর্তব্য বলেই মনে হয়।